লোকসাহিত্যের পত্তন
সিলেটের পত্তন ও মরমী সাহিত্যে
আপনার কুদরত আগে করিতে জাহের
নিজ নুরে আমার নুর পয়দা কৈলেন ফের
আমার নুরেতে পয়দা তামাম জাহান
আরশ, কুরশী, লওহ কলম ও লা-মাকান
পূর্বেতে আছিলা প্রভূ নৈরূপ আকার
ইচ্ছিলেক নিজ সখা করিতে প্রচার
নিজ সখা মোহাম্মদ প্রথমে সৃজিলা
সেই জ্যোতি নুরে ত্রিভূবন নির্মীলা
আবহমান পৃথিবীতে মানুষের আসা যাওয়ার গতি থেমে নেই। তাই বলা হয়, আদিম প্রভাতের অরন্যচারী সরল মানুষের চিন্তা ভাবনাকে কেন্দ্র করেই কাব্যের জন্ম। যে কাব্যে মানুষ ব্যাখ্যা দিয়েছে নিজের অবার্চীন চিন্তা-চেতনার দর্শন। মানুষের চিন্তা-চেতনায় সর্বজীবে পৃথীবির অতিলৌকিক এক শক্তির অস্তিত্ব দেখেছে । যাকে মানুষ প্রেম বলে ধারণায় স্থিতি করে প্রকাশ করেছে ভাব। যুগে যুগে এ ভাব বা প্রেমই বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাষে রুপান্তর বলে জেমস জেয়েস তার বিখ্যাত গ্রন্থ মনোমিথ (Mono Myth)এ বলেছেন । মানুষের মনে বোনা সুরগুলই যে যুগ যুগান্তর পুর্বের লোকসাহিত্য ছিল তা আজ নৃত্বান্তিক ভাবে লোকবিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন । লোকসাহিত্যের এ ক্রমধারা, মুলত অক্ষরজ্ঞানহীন পল্লিবাসীদের স্মৃতি ও শ্রুতির ওপর নির্ভর করে লালিত । এটি ব্যক্তিবিশেষের রচনা হলেও সমষ্টির চর্চায় তা পুষ্টি ও পরিপক্কতা লাভ করে। এজন্য লোকসাহিত্য সমষ্টির ঐতিহ্য, আবেগ, চিন্তা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে । যার ফলে এতে জাতির আত্মার স্পন্দন শোনা যায় । লোকসাহিত্যে লোকসংস্কৃতির এ জীবন্ত ধারা অনুধাবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে ‘জনপদের হূদয়-কলরব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
গবেষকদের মতানুসারে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার ভিন্ন চিন্তা-চেতনা, ধর্ম-বিশ্বাষ ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ-মিলন এবং বিরহে রচিত গাথাই লোকসাহিত্য। যা এক যুগে জন্ম আর অন্য যুগে হয়েছে সংস্কার । উদাহরণ স্বরুপ ভারতীয় সংস্কৃতিকে নেয়া যাক; এক কালে ইন্দোইউরোপীয় সংস্কৃতি ও ভাবধারা এ অঞ্চল প্রফুল্লীত হয়েছিল। পরবর্তিতে বহু ধর্মীয় ভাব ও চিন্তার মিশ্রণে জন্ম দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের। যা আবার বিভিন্ন ভাবধারায় প্রভাম্বিত হয়ে ভিন্ন নামে প্রকাশ-বিকাশ লাভ করেছে ভারতীয় মানব সমাজে। প্রাচীন মানুষের ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-উপচার, জীবনধারা নিয়ে লোক-মানুষের রচিত মৌখিক কেচ্ছা, কাহিনী, যাত্রা-পালা ধাধা ইত্যাদি লোক-ভাণ্ডার জাতীয় সাহিত্যকে ব্যাপ্তি প্রদান করেছে, করেছে সমৃদ্ধ। অতীত দিনে উপাসনায় 'নির্বাণ সঙ্গীত' প্রধান উপকরণ হিসেবে আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে ধরা হয় । বাংলা লোকসঙ্গীত নাম ও প্রকারভেদে বিচিত্র; অঞ্চলভেদে এর প্রায় শতাধিক নাম রয়েছে এবং প্রকারভেদে প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব শ্রেণির গান চিহ্নিত করা যায়। কেউ কেউ আঞ্চলিক ও সর্বাঞ্চলীয়, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক, সাধারণ ও তত্ত্বপ্রধান, তালযুক্ত ও তালহীন এরূপ স্থূলভাবে ভাগ করে সেগুলির আবার নানা উপ-বিভাগ করেছেন। আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকসঙ্গীতকে আঞ্চলিক, ব্যবহারিক, আনুষ্ঠানিক (ritual), কর্মমূলক ও প্রেমমূলক এই পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। আর্য জাতি সহ আরব, তুর্কী, ফার্সি প্রভৃতি ঔপনিবেশিকদের আগমনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন সংস্কৃতিতে সম্মিলিত হয় ঔপভাষিক সংস্কৃত। রচিত হয় বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থ সহ পুথিঁ, লোকসঙ্গীত, প্রবাদ প্রবচন, কিচ্ছা, ধাঁধাঁ ইত্যাদি। সুলতানী আমলে মরমীবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। মরমী ভাবধারা জনমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং এই ভাবধারাই অকৃত্রিম সহজাত ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে সারা ভারত ব্যাপি ।
মরমীবাদের উৎস
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন লোক ঐতিহ্যের অনবদ্য ফসল মরমী সঙ্গীত বা মরমীবাদের গান। মারেফতি বা ফকিরালী গানের পোশাকী নাম মরমী সাহিত্য। প্রাচীন লোকসাহিত্য বা লোকঐতিহ্যের একাংশের রুপান্তর মরমী সাহিত্য।
উল্লেখ্য যে, মরমী সঙ্গীত ও বাউল গানকে অধুনা যুগে যদিও এক করে ভাব হয়, কিন্তু এর ইতিহাস সন্ধানি সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অন্যান্যদের কাছে এর ভাবধারায় ভিন্নতা রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, মরমী সঙ্গীত হচ্ছে সূফীবাদের বহিরপ্রকাশ। যা মুলত তাওহীদ (স্রষ্টার একত্ববাদ) রিসালতের (পয়গাম্বরের কাহিনী) উপর ভিত্তি করে রচিত এবং বাউল মতবাদ হচ্ছে স্রষ্টাই জীব জীবই স্রষ্টা ইত্যাদি বিষয়ের উপর প্রতিষ্টিত। তাই একে ভারতীয় বেদান্তের অদ্বৈত্যবাদ দ্বারা প্রভাম্বিত বলে ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী ধারণা করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে সূফীবাদের আগনম কাল তুর্কি বিজয়ের বহু পূর্বে ছিল বলে হিজরি তৃতীয় শতাব্দির বিখ্যাত আরব পর্যটক সোলায়মান ছয়রাফীর ভ্রমণ কাহিনী থেকে জানা যায়। এ দিক দিয়ে ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী থেকে পাওয়া যায়, মূল আরবীয় সূফীবাদ-ই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে ছিল। খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দির পর আরবীয় সূফীবাদ যখন গ্রিক দর্শনে প্রভাম্বিত হয় তখন থেকে এতে স্রষ্টার একত্ববাদের সাথে জীববাদ ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তুর্কি বিজয়ের মধ্যদিয়ে ভারতে প্রবেশ করে রাজশক্তির হাতে লালিত পালিত হয়ে বৈদান্তিক সাহিত্যের শব্দমালা মিশ্রিত হয়। যার ফলে বৌদ্ধদের কাছে প্রসংশিত হয় এবং বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণবাদ থেকে মুক্তির পথ পেয়ে ইসলামের আর্দশ গ্রহণ করে। বাংলাদেশে সূফীদের আগমনের পথ ছিল চট্টগ্রামের বিখ্যাত বন্দর । এ বন্দর দিয়ে সুফীরা বাংলায় আসেন এবং চ্ট্রগ্রাম সহ সিলেটে আস্তানা গড়ে বসবাস করেন। হিজরী সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে সিলেট বিজয়ের মধ্যদিয়ে সর্বোপরি এ অঞ্চল সুফীবাদের রাজধানীতে পরিণত হয় । পরবর্তিতে এখান থেকে সূফী মতবাদ বিস্পরিত হয় সারা বাংলেদেশে । সে কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সিলেটাঞ্চলের মরমী গীতিকার প্রকারভেদ ভিন্ন বলে অনুমিত। তাই এগুলোকে এ অঞ্চলে সিলেটের মরমী সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইতিহাস অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, মধ্যযুগের শুরু থেকে সিলেট অঞ্চলে জন্ম হয়েছে প্রখ্যাত, অজ্ঞাত অনেক মরমী সাধকদের। যারা হৃদয় বীণার তারে সুরে ছন্দে রচনা করেছেন ঈশ্বর প্রেম সহ সৃষ্টির উপর অসংখ গীত। মানুষের জীবন-জীবিকা, আচার-আচরণ ও সুখ-দুঃখ নিয়ে রচিত এককালের লোকসাহিত্য ঈশ্বর প্রেম, সৃষ্টি তত্ব, জীবে জীবে প্রেম ইত্যাদির মুল্যবুদে সৃষ্টি হয়েছে মরমী সাহিত্যের। এ পৃথিবী নশ্বর বা অনিত্য, এখানের বাসিন্দাদের মিলে মিশে একে অন্যের সাথে জীবনজ্ঞাপন করার নামই হচ্ছে প্রেম । প্রেমকে জাগ্রত করে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীত্ব করাই হচ্ছে মরমী মতবাদের মূল লক্ষ। এ বিষয়ে মধ্যযুগের কবি আলাওল তাঁর পদ্মাবতী কাব্যে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেনঃ
প্রেম বিনে ভাব নাই ভাব বিনে রস
ত্রিভূবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে (হতে) বশ
যার হূদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর
মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর।
মৌলানা রুমি (রহঃ) রচনায় পাওয়া যায় হৃদয়ের গভীর এশক, মহব্বত বা প্রেমের আধ্যাত্মিক বাণী ও সুর লহরীই মরমী সঙ্গীত। ইসলামের দৃষ্টিতে মরমীবাদকে সুফীসাধনা বলা হয়েছে। মৌলানা রুমি (রহঃ) বলেছেন এটি কোন পৃথক মতবাদ নয়। বরং ধর্মীয় চিন্তার একটি প্রকৃতগত পদ্ধতি বিশেষ। যা সৃষ্টি কর্তার কাছে মানবের আত্মসমর্তনেরই একটি ধারা বুঝায়। মরমী কবি তার অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখা দুনিয়ার পার্থিব অপার্থিব বিষয় গুলোকে ছন্দে সুরে ব্যক্তকরে যে বাণী মানুষের কাছে পৌছায়, এটিই মরমী সাহিত্য ডঃ মুমিনুল হক বঙ্গে সুফীবাদ গ্রন্থে বলেছেন; আরবদেশ সূফীবাদের জন্ম দিলেও পারস্য এর লালন পালন করেছে । সুফিবাদ আরবদেশ ছেড়ে যতই পুর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছে ততই পূর্বদেশীয় ভাবধারার সম্মিলন ঘটতে থাকে। অধ্যাপক আসদ্দর আলীর মতেঃ শ্যামল বাংলায় এর বিকাশ কাল ছিল সপ্তম হিজরীর প্রমথ পাদে। সূফী আউলিয়াগণ দ্বারা এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে। হযরত শাহজালাল (রঃ) সহ ৩৬০ আউলিয়ার ভূমী সাবেক সিলেট জেলা বর্তমান সিলেট বিভাগই এর বিকাশ স্থল। এজন্য সিলেটকে বলা হয় বাংলার আধ্যাতিক রাজধানী । যুগ যুগান্তর ধরে সূফী, ফকির, পীর ও আউলিয়ার ক্রমধারায় সিলেটে জন্ম হয়েছে বেশুমার ভাবুক, কবি ও সাধকদের । যারা সুর মুর্ছনার মধ্য দিয়ে মানুষকে দেখিয়েছে পরমাত্মাকে পাওয়ার পথ।
সিলেটের পত্তন ও মরমী সাহিত্যে
ইতিহাসবিদেরা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ধারণা করেন; গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর সমস্ত উত্তর-পূর্ব অঞ্চল নিয়েই গঠিত ছিল প্রাচীন কামরুপ রাজ্য। যার অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রাচীন শ্রীহট্ট বা বর্তমান সিলেট বিভাগ । গ্রীক বণিক 'টলেমির' বাণিজ্য বিস্তার গ্রন্থের অনুবাদে বলা হয়েছে "কিরাদিয়া" বা কিরাত দেশের উত্তরে পার্শ্ববর্তী দেশই প্রাচীন শ্রীহট্ট ভূমি । উল্লেখিত তথ্য মতে শ্রীহট্ট বা সিলেট বিভাগকে একটি প্রাচীন জনপদ ধরা হয়। তদুপরি প্রাচীন কামরুপ রাজ্যের অধিপতি ভগদত্ত রাজার উপ-রাজধানী সিলেট বিভাগের লাউড় পর্বতে বিদ্যমান থাকা এ অঞ্চলের সর্ব-প্রাচীন নিদর্শন । শ্রীহট্ট অঞ্চলে জনশ্রুতি রয়েছে, পৌরাণিক যুগে মহাভারত সমরে নিহত ভগদত্ত কামরুপ রাজ্যের শাসক ছিলেন। রাজা ভগদত্তের আমলে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার আওতাধীন লাউড় অঞ্চলে ছিল কামরুপ রাজ্যের শাখা রাজধানী । লাউড় পাহাড়ের সুরঙ্গ স্থানে ছিল রাজ বাড়ি । প্রাচীনকালে হিন্দু রাজাদের দ্বারা সিলেট শাসিত হয়েছে, যার অনুমান করা হয় নিধনপুরে প্রাপ্ত ভাস্করভর্মনের তাম্রলিপি সহ ভাটেরায় প্রাপ্ত আরো দুই খানা ঐতিহাসিক তাম্রফলক থেকে। ঐতিহাসিক অচ্যুতচরন চৌধুরী তাম্র ফলকদ্বয় পাঠ করে এদেশের পশ্চিমাংশে প্রাচীন কালে বিরাট সাগর বিদ্যমান ছিল বলে, অর্থ করেন। ত্রিপুরার ইতিহাস গ্রন্থের বরাতে লিখেন, শ্রীহট্টের দক্ষিণ পশ্চিমাংশ, ময়মনসিংহের পূর্বাংশ, ত্রিপুরার উত্তর পশ্চিমাংশে পুরাকালে বৃহত্তর হ্রদ ছিল। পরে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় ইহা ভরাট হয়ে, ঢাকা ময়মনসিং ও ত্রিপুরার সন্ধিস্থলে পরিণত হয়েছে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের চীন দেশের পর্যটক হিয়েং সাং এই অঞ্চল ভ্রমণ করে, শ্রীহট্টকে সমুদ্র নিকট বর্তী দেশ উল্লেখ করেন । গবেষনা ও নৃতাত্ত্বিকভাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আর্যজাতির আগমন কাল চতুর্থ-পঞ্চম শতক ধরা হয়। ভারতবর্ষের আর্যযুগের শুরুতে বঙ্গদেশে জনবসতি স্থাপনের প্রমাণ ছিলনা, তখন সিলেট একটি দেশ হিসেবে খ্যাত ছিল। যখন রামায়ণ লিখিত হয় তখন বঙ্গভূমী আর্যগণের কাছে পরিচিত ছিল, কিন্তু মানুষ বাসযোগ্য ছিল না। সে সময় উত্তর-পূর্ব বঙ্গই বঙ্গভূমী হিসেবে বাসযোগ্য ছিল। ভূ-তত্ববিদ বম্কিমচন্দ্র ও রমেশচন্দ্র গং ও অন্যান্য ঐতিহাসিক লিখেন; প্রাগৈতিহাসিক যুগে সিলেট সভ্য জাতির আবাসভূমি ছিল। ইহা প্রাচীন গ্রন্থাদি সহ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যায়। বরাক বা বরবক্র, সুরমা, কুশিয়ারা এই বিভাগের প্রধান নদী। মণু ও ক্ষমা ইত্যাদি ক্ষীন নদী বরবক্রে মিশে প্রবাহিত হত। প্রাচীন শাস্ত্রে বিশ্বাসী হিন্দুগণ বরবক্র ও মণু নদীতে তীর্থযাত্রায় আসতো। বরবক্র, মণু ও ক্ষমা নদীগুলো এ অঞ্চলের ভূমি বিস্তার এবং উক্ত নদী গুলোকে ঘিরে তীর্থযাত্রীদের আসার মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের জনবসতি বিস্তারের অনুমান করা হয়। রামায়ণে অয্যোধ্যাকাণ্ডের দশরত রাজার অধিকৃত দেশগুলোর মধ্যে বিশেষ দশটি জনপদের উল্লেখ আছে; সেগুলো দ্রাবিড়, সিন্ধু, সৌরাষ্ট, সৌবির, দক্ষিণাপথ, অঙ্গ, বঙ্গ, মগদ, মৎস ও কোশাল রাজ্য । উক্ত দশটি রাজ্যের মধ্যে যে বঙ্গের উল্লেখ রয়েছে, উহা মুলতঃ ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিমে অবস্থিত বর্তমান "ভাগলপুর" অঞ্চল ।
বাংলার ইতিহাসে বলা হয় যে, প্রাচীন কালে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী বাংলাদেশকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক করে রেখেছিল। পূর্ব বঙ্গের (বাংলাদেশের) সিলেট, ঢাকা, রংপুর, চ্ট্টগ্রাম, ভুটান এবং আসাম তখনকার সময়ে কামরুপ রাজ্যের অধীন গণ্য ছিল। পুর্ব বঙ্গের উল্লেখিত অঞ্চল গুলোর মধ্যে সিলেটই সর্ব প্রাচীন হিসেবে বিবেচিত হয়। (Ancient india) প্রাচীন ইন্ডিয়া গ্রন্থে পাওয়া যায়, প্রাচীন কালে কামরুপ রাজ্য প্রাচীন নদী 'করতোয়া' পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল (On the Early 6th century A.D. kamarupa became a powerful kingdom. It included the whole of the brahmaputra vally and sylhet, and extended to west as far as Karatoya river which continued to be the traditional boundary of kamarupa for a long time)।
সিলেটের আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ অনুসারে প্রাচীন সীমানার যে উল্লেখ পাওয়া যায় সে অনুসারে তৎকালীন শ্রীহট্টমণ্ডল বর্তমান সিলেট বিভাগের চেয়ে আয়তনে অনেক বড় ছিল, এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান সরাইল বা সতরখণ্ড ( জেলার অন্তর্গত), জোয়ানশাহী (বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত), ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, করিমগঞ্জ, কাছাড় জেলা ও বদরপুর শ্রীহট্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চলে আর্যদের বহু পূর্বে অস্ট্রেলীয়, দ্রাবিড় মঙ্গোলীয়সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বসবাস করত। গারো, খাসিয়া, নাগা, কুকি প্রভৃতি আধিবাসীদের প্রাচীন কাব্য, ভাষা, ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-উপচারে প্রফুল্লীত সাহিত্যে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে মিশ্রণ ঘটে আর্য সংস্কৃতির।
কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মার রাজ্যপাট বঙ্গে বিস্তৃত হয়নি তবে সিলেট তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সময় বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির অভ্যুদয় ও প্রসারে সিলেট বৌদ্ধ সভ্যতার লালনক্ষেত্রে পরিণত হয় । পাল রাজত্বের সময়েও সিলেটে বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশ অব্যাহত ছিল । পর্বতীতে সেন রাজাদের নিপীড়নে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয় ঘটলে মীননাথ-গোরক্ষনাথ প্রবর্তিত চুয়াশি সিদ্ধাচার্যের অনুসারীরা এদেশ ছেড়ে নেপালে-আসামে-তিব্বতে আশ্রয় নিয়ে থাকেন । বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শণ চর্যাপদ তাদেরই অমর সাহিত্যকীর্তি । ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই চর্যাগীতিকাকে ইরানী গজলের পূর্বসূরী বলার প্রয়াস পেয়েছেন । বৌদ্ধ অধ্যাত্মবাদ ও ইসলামী মরমীবাদের একটি যোগসূত্রের আভাস এখানে রয়েছে । কারণ চৈতন্য বা নিমাইয়ের ধর্মমতের দার্শনিক নাম হলো অদ্বৈতবাদ যা ইসলামী সূফীবাদের প্রতি উন্মুখ ও সংলগ্ন রাধা-কৃষ্ণের রূপকল্পের পরবর্তী বিকাশ । এ থেকে এক পর্যায়ে সূফীতাত্তিক আশিক-মাশুকের ধারণা প্রবিষ্ট হয় ।
সাত শত হিজরী থেকে মুসলমানদের আগমনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহজালাল সহ ৩৬০ আউলিয়ার আগমনে সুফীবাদের প্রচলন শুরু হয়। আগত সুফী সাধকরা ইসালামিক আদর্শ ছড়িয়ে দিতে এখানকার আদিবাসীদের বিভিন্ন ভাষায় শিক্ষা দেন ইসলামিক পদ্ধতি বা রীতি রেওয়াজ। সুফী, দরবেশ ও মাশায়েখগণ ভক্ত অনুরুক্তদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছিয়ে দিতে খানকা প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীকালে ঐ খানকাগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর হয় । অতঃপর খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দিতে সিলেটে সংস্কৃত মিশ্রিত বাংলা লিপির বিকল্প লিপি হিসেবে সিলেটি নাগরী নামে একটি লিপি বা বর্ণমালার উদ্ভাবন হয়। সিলেটের মরমী কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে নাগরী লিপি চর্চা হত । এ লিপিতে রচিত সাহিত্যকে (সিলেটি) বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন স্বরুপ গণ্য করা হয়। নাগরী লিপিতে রচিত হালাতুন নবী পুথিঁকেই সিলেটের শ্রেষ্ঠ কাব্য গ্রন্থ সমুহের অন্যতম মনে করা হয়। সিলেটের কবি সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষা ও সিলেটি নাগরী ভাষা সহ আরো কয়েকটি ভাষায় সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য রেখেছেন। পনের’শ শতাব্দির শুরু থেকে সিলেটবাসীরা যে সমস্ত ভাষায় সাহিত্য রচনা করে গেছেন, সেগুলো হলো-(১) সংস্কৃত (২) বাংলা (৩) সিলেটি নাগরী (৪) আরবি (৫) ফার্সি (৬) উর্দু । যার মধ্যে অন্যতম আরবী ফার্সী ও উর্দু । উল্লেখ্যিত ভাষা গুলোর সমন্নয়ে মরমী সাহিত্য নামে জন্ম নেয় এক নতুন সাহিত্যের । যাকে আজ কাল বলা হয় মরমী সাহিত্য। এর উৎপত্তি হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের বিভাগীয় শহর সিলেট । এখানকার লোককবিদের রচিত বাংলা, নাগরী , আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষার কাব্য, পুথি গান ও পালা ইত্যাদি নিয়ে মরমী সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয় বলে চৌধুরী গোলাম আকবর সহ গবেষকগণ লিখেন । সিলেটের প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে মদনুল ফওয়ায়েদ নামের ইসলামী গ্রন্থ । লিখেছেন শাহ সৈয়দ ইসরাইল, গ্রন্থের ভাষা ফারসি । শ্রীহট্টের পৈলের সৈয়দ বংশের শাহ সৈয়দ রেহান উদ্দীন ফার্সী ভাষায় কবিতা লিখে 'বুলবুলে বাংলা' উপাধিতে খ্যাত হন। তিনি উর্দু ভাষায় 'মসনবীয়ে বাকাউলী' খাবনামা গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। আরবী ফার্সী প্রচার ও প্রসারের জন্য এ অঞ্চলে প্রবাদ ছিলঃ
সিলেটের আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ অনুসারে প্রাচীন সীমানার যে উল্লেখ পাওয়া যায় সে অনুসারে তৎকালীন শ্রীহট্টমণ্ডল বর্তমান সিলেট বিভাগের চেয়ে আয়তনে অনেক বড় ছিল, এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান সরাইল বা সতরখণ্ড ( জেলার অন্তর্গত), জোয়ানশাহী (বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত), ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, করিমগঞ্জ, কাছাড় জেলা ও বদরপুর শ্রীহট্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চলে আর্যদের বহু পূর্বে অস্ট্রেলীয়, দ্রাবিড় মঙ্গোলীয়সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বসবাস করত। গারো, খাসিয়া, নাগা, কুকি
কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মার রাজ্যপাট বঙ্গে বিস্তৃত হয়নি তবে সিলেট তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সময় বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির অভ্যুদয় ও প্রসারে সিলেট বৌদ্ধ সভ্যতার লালনক্ষেত্রে পরিণত হয় । পাল রাজত্বের সময়েও সিলেটে বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশ অব্যাহত ছিল । পর্বতীতে সেন রাজাদের নিপীড়নে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয় ঘটলে মীননাথ-গোরক্ষনাথ প্রবর্তিত চুয়াশি সিদ্ধাচার্যের অনুসারীরা এদেশ ছেড়ে নেপালে-আসামে-তিব্বতে আশ্রয় নিয়ে থাকেন । বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শণ চর্যাপদ তাদেরই অমর সাহিত্যকীর্তি । ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই চর্যাগীতিকাকে ইরানী গজলের পূর্বসূরী বলার প্রয়াস পেয়েছেন । বৌদ্ধ অধ্যাত্মবাদ ও ইসলামী মরমীবাদের একটি যোগসূত্রের আভাস এখানে রয়েছে । কারণ চৈতন্য বা নিমাইয়ের ধর্মমতের দার্শনিক নাম হলো অদ্বৈতবাদ যা ইসলামী সূফীবাদের প্রতি উন্মুখ ও সংলগ্ন রাধা-কৃষ্ণের রূপকল্পের পরবর্তী বিকাশ । এ থেকে এক পর্যায়ে সূফীতাত্তিক আশিক-মাশুকের ধারণা প্রবিষ্ট হয় ।
সাত শত হিজরী থেকে মুসলমানদের আগমনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহজালাল সহ ৩৬০ আউলিয়ার আগমনে সুফীবাদের প্রচলন শুরু হয়। আগত সুফী সাধকরা ইসালামিক আদর্শ ছড়িয়ে দিতে এখানকার আদিবাসীদের বিভিন্ন ভাষায় শিক্ষা দেন ইসলামিক পদ্ধতি বা রীতি রেওয়াজ। সুফী, দরবেশ ও মাশায়েখগণ ভক্ত অনুরুক্তদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছিয়ে দিতে খানকা প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীকালে ঐ খানকাগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর হয় । অতঃপর খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দিতে সিলেটে সংস্কৃত মিশ্রিত বাংলা লিপির বিকল্প লিপি হিসেবে সিলেটি নাগরী নামে একটি লিপি বা বর্ণমালার উদ্ভাবন হয়। সিলেটের মরমী কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে নাগরী লিপি চর্চা হত । এ লিপিতে রচিত সাহিত্যকে (সিলেটি) বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন স্বরুপ গণ্য করা হয়। নাগরী লিপিতে রচিত হালাতুন নবী পুথিঁকেই সিলেটের শ্রেষ্ঠ কাব্য গ্রন্থ সমুহের অন্যতম মনে করা হয়। সিলেটের কবি সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষা ও সিলেটি নাগরী ভাষা সহ আরো কয়েকটি ভাষায় সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য রেখেছেন। পনের’শ শতাব্দির শুরু থেকে সিলেটবাসীরা যে সমস্ত ভাষায় সাহিত্য রচনা করে গেছেন, সেগুলো হলো-(১) সংস্কৃত (২) বাংলা (৩) সিলেটি নাগরী (৪) আরবি (৫) ফার্সি (৬) উর্দু । যার মধ্যে অন্যতম আরবী ফার্সী ও উর্দু । উল্লেখ্যিত ভাষা গুলোর সমন্নয়ে মরমী সাহিত্য নামে জন্ম নেয় এক নতুন সাহিত্যের । যাকে আজ কাল বলা হয় মরমী সাহিত্য। এর উৎপত্তি হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের বিভাগীয় শহর সিলেট । এখানকার লোককবিদের রচিত বাংলা, নাগরী , আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষার কাব্য, পুথি গান ও পালা ইত্যাদি নিয়ে মরমী সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয় বলে চৌধুরী গোলাম আকবর সহ গবেষকগণ লিখেন । সিলেটের প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে মদনুল ফওয়ায়েদ নামের ইসলামী গ্রন্থ । লিখেছেন শাহ সৈয়দ ইসরাইল, গ্রন্থের ভাষা ফারসি । শ্রীহট্টের পৈলের সৈয়দ বংশের শাহ সৈয়দ রেহান উদ্দীন ফার্সী ভাষায় কবিতা লিখে 'বুলবুলে বাংলা' উপাধিতে খ্যাত হন। তিনি উর্দু ভাষায় 'মসনবীয়ে বাকাউলী' খাবনামা গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। আরবী ফার্সী প্রচার ও প্রসারের জন্য এ অঞ্চলে প্রবাদ ছিলঃ
ফার্সী জানে না যে কুমারতারে মুহ করমু না ভাতার'। সিলেটে ফার্সী ভাষার প্রভাব ছিল বেশী। এ বিষয়টি মধ্যযুগীয় কবি সৈয়দ সুলতান রচিত নবী বংশ গ্রন্থে এভাবে উল্লেখ্য হয়েছে;আরবী ফার্সী ভাষে কিতাব বহুতআলেমানে বুঝে, না বুঝে সুত । সিলেটে ঔপনিবেশীক ভাষার আগমন ঘটলে হিন্দুসংস্কৃত ভাষায় এর প্রভাব পরে । ফলে ধীরে ধীরে সংস্কৃত ভাষা তার পরিচিতি হাড়াতে থাকে। যার ঈঙ্গিত পাওয়া যায় চৈতন্য মঙ্গল কাব্যে, কবি জয়ানন্দের লিখা থেকেঃ তিনি লিখেনঃব্রাহ্মন রাখিবে দাড়ি পারস্য পড়িবেমোজা পায়ে নড়ি হাতে কামান ধরিবেমসনবী আবৃত্তি করিবে দ্বিজবরজকাচুরি ঘাটি ঘটিবেক নিরন্তর।
এছাড়া উর্দু, আরবী ও ফার্সী ভাষায় 'উর্দূ ব্যাকরণ' 'রেয়াজুল নুর' 'গোল দস্তে আকাঈদ' নামের বিভিন্ন গ্রন্থ সহ পীর আউলিয়াদের জীবনি ইত্যাদি লিখিত বহু গ্রন্থ সিলেটের প্রাচীন সাহিত্যের স্বাক্ষর হয়ে সংরক্ষিত হচ্ছে বাংলা লোকসাহিত্যে । সিলেট অঞ্চলে রচিত ইসলামি গ্রন্থ (কিতাব) সহ পই-পুঁথি, গজল-কবিতা, ডাক-ডিঠান, ধাঁধাঁ-ছিলক, জারী-সারী ইত্যাদিকে অঞ্চলিক লোকঐতিহ্য বলে ধরা হয় ।
১৩০০ খ্রিস্টাব্দের গুড়াথেকে পীর আউলিয়ার আনিত সংস্কৃত ইসলামীক মতবাদ যখন সিলেট অঞ্চল প্লাভিত করে ছিল, তখন থেকে সাধক ফকিরদের চেষ্টা-প্রচেষ্টায় মানুষকে শিক্ষা দেয়ার মাধ্যম হিসেবে লোকসাহিত্যের ব্যবহার ধীরে ধীরে পীর আউলিয়ার সাধনাগার (খানকায়) প্রতিষ্টা লাভ করে । আঞ্চলিক লোকসাহিত্য ইসলাম দ্বারা প্রবাম্ভিত হয়ে খ্যাত হয় মুর্শিদি\ফকিরালী গান বা মরমী সঙ্গীত নামে । খোদা প্রেমিক লোকমানুষ প্রেম পিপাসায় দগ্ধ হয়ে সুর মুর্ছনায় মাধ্যমে যে ভাবের কথা ব্যক্ত করে, ইহাই মরমী সঙ্গীত । আধ্যাত্মিক সুর মুর্ছনার কাফেলায় সিলেটের অবস্থান প্রথম কাতারে। কারণ হচ্ছে হাজার হাজার আউলিয়ার সংস্রব পেয়ে এ অঞ্চলের মানুষ যুগ যুগ ধরে ভাব দেশের বাসিন্দায় পরিণত ।
বাউল সাধনা ও মরমী বাদের মিশ্রণ
মরমী কবিরা তাসাউফপন্থী। মরমীবাদ ও সূফীতত্ত্ব সাধারণত মুর্শিদ প্রদর্শিত তরিকার নামে পরিচিত। এশক্, মহববত বা আল্লাহ প্রেমই মরমী সঙ্গীতের বিষয়বস্তু । পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্যের ভেদবিধি নিয়েই মরমী কবিরা সঙ্গীত রচনা করেন। সিলেটের প্রায় সব মরমী কবিগণ চিশতীয়া তরিকার অনুসারী। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (র.) (১১৪২-১২৩৬) দ্বাদশ শতাব্দিতে ভারত উপমহাদেশে আজমির শরীফে এ তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম সূফী সাধকদের ইসলামের বাণী নিয়ে এ দেশে আগমনকাল থেকেই ‘মরমী বা ছামা সঙ্গীতের' প্রচলন হয়। তাই সুলতানী আমলে মরমীবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে বলে গবেষকদের ধারণা । মরমীবাদের বিকাশের শুরু থেকেই মরমী ভাবধারা জনমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং এই ভাবধারাই অকৃত্রিম সহজাত ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে পরবর্তিতে (আনুমানিক ১৬৫০খ্রিঃ) চৈতন্যবাদ ও জগন্মোহনী ভাবধারার সংমিশ্রণে বাউল মতবাদের জন্ম হওয়ায় বৈঞ্চব পদাবলীতে মরমীবাদ সাহিত্যের প্রভাব পড়ে। বৈঞ্চব পদাবলীর পুর্বরাগ, অনুরাগ, বংশী, বিরহ, সম্মিলন ইত্যাদি শব্দ নামে উপনামে সূফীবাদ থেকে সরাসরি গ্রহন করা হয়। এভাবে সূফীবাদকে বৈঞ্চব্বাদে সংযুক্ত করে একটা ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে বলে গবেষকগণ অনুমাণ করেন । জগমোহন গোসাঈ বাউল সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয়। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার মাছুলিয়া গ্রামে তার আখড়া বিদ্যমান। জগন্মোহিনী সম্প্রদায়ের জপতপের মূলমন্ত্র ‘গুরু সত্য'। জগমোহন গোসাইর এক প্রশিষ্যের নাম রামকৃষ্ণ গোসাঈ। বানিয়াচং উপজেলার বিথঙ্গলে তার প্রধান আখড়া রয়েছে। এ আখড়ার অধীনে প্রায় চারশ' ছোট বড় শাখা আখড়াও আছে। হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে এ সম্প্রদায়ের অনেক বাউল-বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী ছিল ও আছে। রামকৃষ্ণ গোসাঈর বারো জন শিষ্যের নামে বারোটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকার ফরিদাবাদেও এ সম্প্রদায়ের একটি বড় আখড়া আছে। এরা কোন ধরনের জাতপাতের ধার ধারে না। আজকাল এদের প্রভাবে এক শ্রেণীর মুসলমান বাউলদের মাঝে ঢুকে হালাল-হারাম আছ্-বাচে বিশ্বাষ রাখে না । ফলে সুফিদের প্রবর্তিত মরমী সাধনা থেকে সরে গেছে দূরে । বাউল সাধনা ও মরমী সাধনার মধ্যকার ফারাকটুকু অনুমান না করাই হচ্ছে এর বিশেষ কারন। মরমী সাধকরা সব সময় ধর্ম শিক্ষার অনুকূলে সাহিত্য রচনা করেছেন । যদিও বিভিন্ন বিষয়ের মত প্রকাশে বাউলদের বঞ্চব সাহিত্য ধারার ব্যবহার করেছেনা। সাধনা ও চেতনার ক্ষেত্রে তারা ছিলেন ইসলামের অনুসারী। নবী করিম (সাঃ) এর নির্দেশিত পথে আত্মশুদ্বি করে ইসলামের বাহ্য ও অন্তর জীবনের প্রেমপূর্ণ বাস্তব অনুশীলনেরমাধ্যমে পরম সত্তার পূর্ণ জ্ঞানার্জন ও তার নৈকট্য লাভ মরমীদের লক্ষ । এথেকে বিচ্যুত হওয়াটাই দুঃখ জনক। সূফী সাধক ও মরমী কবি সৈয়দ জহুরুল হুসেন (র.) (১৮৭৬-১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ মধুপুর-বাহুবল-হবিগঞ্জ) এদের বে-শরা কাজ কারবারের বর্ণনা করেছেন এভাবে :
কি হৈল আখেরী কালে
ঝুটা পীরে শিক্ষা দিল গান-বাজনা জিকিরের তালে
নামাজ রোজার নাই লেশ, গান বাজনা জিকিরে বেশ
অঙ্গে ঘটায় আজব বেশ, লুণ্ঠন করে হাতের তালে
নামাজ রোজা নাই করিল, দলিল মতে কাফির হৈল
ঈমান আমান সব হারিল ঝুটা পীরের ঠেকে জালে
বালক পীর কাম বেপারী, ছুটে আসে কত নারী
একে অন্যে মাশুকদারী, গোল ঘটায় সব এক মফিলে
পীর বলে নাই আপন পর, আসা-যাওয়া কর বিস্তর
অপর নারী মাশুক ধর, মত্ত হয় সব বালক দলে
‘নাউজ্জুবিল্লাহ' এই তরিকায়, শয়তান তথায় শীঘ্র যায়
দলে দলে নরকে যায়, বড় পীর লিখেন দলিলে
জহুর বলে ব্যক্ত কথা, মনে কেহ না পাও ব্যথা
খাজা মঈনুদ্দীনের বার্তা ‘মক্তুবাতে' এসব মিলে।
মধ্যযুগের সিলেটি মরমী কবিরা
বাংলাদেশে ইসলাম রাজকীয় রূপ নিয়ে আসেনি। পীর ফকির ও সুফী সাধকেরাই এ দেশে মুলত ইসলাম প্রচার করেছেন । ইসলাম ধর্মের প্রধান লক্ষ্য মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি। এ লক্ষকে সামনে রেখেই সুফীবাদের যাত্রা। ইসলাম অনুমোদিত দুটি পথ শরীয়ত-মারিফত। এ দুইয়ের যোগফলকে সংক্ষেপে বলা হয় তাসাউফ । তাসাউফের মাধমে মানুষ আল্লাহর তা'য়ালার নৈকট্য লাভ করতে পারে। ইসলামি দৃষ্টিতে 'আধ্যাতিকতা' আত্মার পরিশুদ্ধি বুঝায়। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেনঃ মানবদেহে এক খণ্ড মাংস রয়েছে, সেটি শুদ্ধ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে। আর তা হলো আত্মা বা হৃদয় । হৃদয় বা আত্মাকে সুস্থ রাখার একমাত্র পথ হলো আল্লাহর যিকির করা। আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে বলেছেন; 'আলা বি-যিককরিল্লাহি তাতমা ই'নুল ক্বুলুব' অর্থঃ- আল্লাহর যিকিরে ক্বলবে শান্তী আসে। এই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ন রূপে আল্লাহ'তে নিমগ্ন হওয়াটাই ইসলামি মতানুসারে মানব জীবনের সার্তকতা । ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী আত্মার শুদ্ধি অবলম্বনের পথ পরিক্রমা বা পরিভ্রমনকে তরিকত বুঝায় । মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের পূর্বে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ধন্যছিল।
তখন মানুষ রূহ জগতের বাসিন্ধা ছিল । সেই জগত থেকে পরিভ্রমণের মাধমে আলমে মালাকুত হয়ে আলমে নাছুতে স্থানান্তর হয়। সেখান থেকে আসে দুনিয়ায়। যাকে বলা হয় আলমে জবরুত । আলমে জবরুত হচ্ছে মানুষের কর্মস্থল। বাহ্যিক ভাবে শরীয়তের ইবাদতের অনুশীলন করে বিশেষ কর্মপদ্ধতি 'তরিকত' অনুযায়ী অভ্যন্তরীন বা আধ্যাত্মিক আলোক দ্বারা সুসম্পন্ন হতে হয়। আর এতেই মিলে আল্লাহর সন্তুষ্টি। সূফী সাধনায় মারিফাত অন্যতম। তবে ইলমে তাসাউফের মর্মমূল হচ্ছে শরীয়ত। মধ্যযুগের মরমী কবিরা ছিলেন ভাবুক সচেতন। তাদের রচনায় রয়েছে ভাব, বিরহ ও আল্লাহর সাথে মিলনের আশা । সুফী শ্রেষ্ট মাওলানা রুমি (রহঃ) তার বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থে আল্লাহর মিলন সম্পর্কে বলেন;
ইসলামের বাণী নিয়ে সিলেটে আগত সুফী সাধকরা ইসালামিক আদর্শ ছড়িয়ে এদেশের মানুষকে করেছেন ভাবদেশের বাসিন্ধা। যার ফলে এখানে জন্মেছেন অসংখ ভাবুক কবি সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে যাদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান ।
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদেও রয়েছে সিলেট অঞ্চলের মানুষের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। সিলেটের উচু নীচু পাহাড় টিলা, সবুজ-শ্যামল মাঠ, নদনদীর অবাধ গতিধারার সাথে একীভূত হয়ে এ অঞ্চলের জারি, সারি, ভাটিয়ালী, পালা, মেয়েলী গান, মরমীগান, কীর্তন-সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যকে।
কবিদের গীতি থেকেই কালক্রমে বয়ে চলেছে বৈষ্ণব সহজিয়া গান, বৈষ্ণব ও শাক্ত পদাবলি, আউল-বাউল-মারফতি-মুর্শিদি গানের প্রবাহ। এগুলির অন্তর্নিহিত গূঢ়ার্থ বাহ্য স্থূলার্থ থেকে স্বতন্ত্র। প্রচলিত স্থূলার্থের আবরণে ধর্মসাধনার এবং জগৎ-জীবনভাবনার নিগূঢ় সংকেত নির্দেশ করাই মরমীবাদের উদ্দেশ্য। পূর্বে বলা হয়েছে, সূফী সাধনায় মারিফাত অন্যতম। তবে ইলমে তাসাউফের মর্মমূল হচ্ছে শরীয়ত। মধ্যযুগের মরমী কবিরা ছিলেন ভাবুক সচেতন। তাদের রচনায় রয়েছে ভাব, বিরহ ও আল্লাহর সাথে মিলনের আশা । মৌলভীবাজার জেলায় কুলাউরা উপজেলার ঘরগাও গ্রামে মতান্তরে জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে জন্ম মরমী কবি শাহনুর (জন্মঃ ১৭৩০- মৃত্যু ১৮৫৪) প্রেম বিরহে বন্ধু পাওয়ার আশায় লিখেনঃ
বাংলাদেশে ইসলাম রাজকীয় রূপ নিয়ে আসেনি। পীর ফকির ও সুফী সাধকেরাই এ দেশে মুলত ইসলাম প্রচার করেছেন । ইসলাম ধর্মের প্রধান লক্ষ্য মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি। এ লক্ষকে সামনে রেখেই সুফীবাদের যাত্রা। ইসলাম অনুমোদিত দুটি পথ শরীয়ত-মারিফত। এ দুইয়ের যোগফলকে সংক্ষেপে বলা হয় তাসাউফ । তাসাউফের মাধমে মানুষ আল্লাহর তা'য়ালার নৈকট্য লাভ করতে পারে। ইসলামি দৃষ্টিতে 'আধ্যাতিকতা' আত্মার পরিশুদ্ধি বুঝায়। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেনঃ মানবদেহে এক খণ্ড মাংস রয়েছে, সেটি শুদ্ধ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে। আর তা হলো আত্মা বা হৃদয় । হৃদয় বা আত্মাকে সুস্থ রাখার একমাত্র পথ হলো আল্লাহর যিকির করা। আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে বলেছেন; 'আলা বি-যিককরিল্লাহি তাতমা ই'নুল ক্বুলুব' অর্থঃ- আল্লাহর যিকিরে ক্বলবে শান্তী আসে। এই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ন রূপে আল্লাহ'তে নিমগ্ন হওয়াটাই ইসলামি মতানুসারে মানব জীবনের সার্তকতা । ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী আত্মার শুদ্ধি অবলম্বনের পথ পরিক্রমা বা পরিভ্রমনকে তরিকত বুঝায় । মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের পূর্বে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ধন্যছিল।
তখন মানুষ রূহ জগতের বাসিন্ধা ছিল । সেই জগত থেকে পরিভ্রমণের মাধমে আলমে মালাকুত হয়ে আলমে নাছুতে স্থানান্তর হয়। সেখান থেকে আসে দুনিয়ায়। যাকে বলা হয় আলমে জবরুত । আলমে জবরুত হচ্ছে মানুষের কর্মস্থল। বাহ্যিক ভাবে শরীয়তের ইবাদতের অনুশীলন করে বিশেষ কর্মপদ্ধতি 'তরিকত' অনুযায়ী অভ্যন্তরীন বা আধ্যাত্মিক আলোক দ্বারা সুসম্পন্ন হতে হয়। আর এতেই মিলে আল্লাহর সন্তুষ্টি। সূফী সাধনায় মারিফাত অন্যতম। তবে ইলমে তাসাউফের মর্মমূল হচ্ছে শরীয়ত। মধ্যযুগের মরমী কবিরা ছিলেন ভাবুক সচেতন। তাদের রচনায় রয়েছে ভাব, বিরহ ও আল্লাহর সাথে মিলনের আশা । সুফী শ্রেষ্ট মাওলানা রুমি (রহঃ) তার বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থে আল্লাহর মিলন সম্পর্কে বলেন;
বাঁশী যখন বাঁযে শোন দিয়া মন
প্রাণ বন্ধুয়ার লাগি বাঁশি কৰিছে ক্রন্দন।
ইসলামের বাণী নিয়ে সিলেটে আগত সুফী সাধকরা ইসালামিক আদর্শ ছড়িয়ে এদেশের মানুষকে করেছেন ভাবদেশের বাসিন্ধা। যার ফলে এখানে জন্মেছেন অসংখ ভাবুক কবি সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে যাদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান ।
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদেও রয়েছে সিলেট অঞ্চলের মানুষের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। সিলেটের উচু নীচু পাহাড় টিলা, সবুজ-শ্যামল মাঠ, নদনদীর অবাধ গতিধারার সাথে একীভূত হয়ে এ অঞ্চলের জারি, সারি, ভাটিয়ালী, পালা, মেয়েলী গান, মরমীগান, কীর্তন-সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যকে।
কবিদের গীতি থেকেই কালক্রমে বয়ে চলেছে বৈষ্ণব সহজিয়া গান, বৈষ্ণব ও শাক্ত পদাবলি, আউল-বাউল-মারফতি-মুর্শিদি গানের প্রবাহ। এগুলির অন্তর্নিহিত গূঢ়ার্থ বাহ্য স্থূলার্থ থেকে স্বতন্ত্র। প্রচলিত স্থূলার্থের আবরণে ধর্মসাধনার এবং জগৎ-জীবনভাবনার নিগূঢ় সংকেত নির্দেশ করাই মরমীবাদের উদ্দেশ্য। পূর্বে বলা হয়েছে, সূফী সাধনায় মারিফাত অন্যতম। তবে ইলমে তাসাউফের মর্মমূল হচ্ছে শরীয়ত। মধ্যযুগের মরমী কবিরা ছিলেন ভাবুক সচেতন। তাদের রচনায় রয়েছে ভাব, বিরহ ও আল্লাহর সাথে মিলনের আশা । মৌলভীবাজার জেলায় কুলাউরা উপজেলার ঘরগাও গ্রামে মতান্তরে জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে জন্ম মরমী কবি শাহনুর (জন্মঃ ১৭৩০- মৃত্যু ১৮৫৪) প্রেম বিরহে বন্ধু পাওয়ার আশায় লিখেনঃ
বন্ধু তর লাইগা-রে আমার তনু জর জর
মনে লয় ছাড়িয়া যাইতাম, থইয়া বাড়ি ঘর
অরণ্য জঙ্গলার মাঝে আমার ভাঙ্গা ঘর
ভাইও নাই বান্ধবও নাই কে লইবে খবর
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর গতানুগতিক পরিসীমায় রোমান্টিকপ্রণয় কাব্যধারা প্রবর্তনকারী হিসাবে মুসলমান কবিগণের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। এ সময়ে আরবী, ফার্সী, ও হিন্দি সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও ভাববৈচিত্র্য অবলম্বনে বাংলা ভাষায় কাব্য রচনায় এক নবযুগ সৃষ্টি করেন মহাকবি উপাদি খ্যাত সৈয়দ সুলতান (জন্ম আনুঃ ১৫৫০-মৃত্যু ১৬৪৮, লস্করপুর হবীগঞ্জ জেলা)। তিনি স্বধর্মে রক্ষণশীল, জ্ঞানী-গুণী-বিচক্ষণ ও দূরদর্শী কবি ছিলেন । এপর্যায়ের কবিগণের মধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বিচারে মহাকবি সৈয়দ সুলতানকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয় ।
যুগ-কাল পরিবর্তনে বাংলায় অনূদিত রামায়ণ মহাভারত এবং দীন ভবানন্দের লেখা বাংলা ‘হবিবংশ’ সিলেটের মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল । সে জন্যেই সিলেটের যে সব মুসলমানেরা বাংলা লিপি পড়তে অজ্ঞ ছিলেন তাদের সাহিত্যিক রস পিপাসা নিবারণের কারণে সৈয়দ সুলতান ‘নবীবংশ’ লিখতে উৎসাহিত হয়েছিলেন । প্রায় পঁচিশ হাজার পংক্তিতে রচিত এ কাব্যে ‘হামদ’ অর্থাৎ আল্লাহ পাকের গুণকীর্তনের মধ্য দিয়ে কবি তাঁর মহাকাব্যের পর্দা উন্মোচন করেছেন । গ্রন্থের প্রথম চারটে পংক্তি এই-
প্রথমে প্রণমি প্রভু অনাদি নিধান
নিমিষে সৃজিছে যেই এ চৌদ্দ ভুবন ৷
আদি অন্ত নাহি তার নাহি স্থান স্থিত ৷
খন্ডন বর্জিত রূপ সর্বত্রে ব্যাপিত ।
ইসলামের শাশ্বত বাণী গানে ও লিখার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেয়া ছিল সিলেটের সুফী সাধকদের জীবনের লক্ষ্য। দুনিয়ার লাভ লোভ মোহ মায়ার ঊর্ধে জীবনযাপন করাই ছিল তাঁর জীবনাদর্শের অন্যতম। ফকির শিতা লং শাহ (জন্ম; ১৮০৬-মৃত্য ১৮৯৯) একজন খ্যাতনামা মরমী সাধক কবি ও সাহিত্যিক। তাওহিদ, রিসালত, আখেরাত ও মানব জীবনের ভেদ রহস্য উদঘাটন হচ্ছে তাঁর গানের মূল বিষয়বস্ত।
শিতালং ফকিরে বলে - ও মুমিন বৃথা আইলায় দুনিয়ায়
আল্লাহ আল্লাহ বল ভাই-রে - তরাইবানে ইল্লাল্লায়।
আল্লাহ আল্লাহ বল ভাই-রে - তরাইবানে ইল্লাল্লায়।
অতপর অধুনা যুগে এসে মরমী কবি দেওয়ান হাছন রাজায় লিখেন;
বিকাইলেনি ঐ বন্ধে কিনে গো সজনী সই, বিকাইলেনী ঐ বন্ধে কিনে
ছাইড়া থাকতে পারবনা গো কি হইল মোর মনে - গো সজনী সই
তার লাগিয়া প্রাণে আমার দৈর্য নাহি মানে
কি জানি কি কৈলগো মোরে মন-মোহনে
তার সম কেহ নাই এই ত্রিভূবনে
তার মত নাহি দেখি ধিয়ানে গিয়ানে।
মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে সিলেটের সুনাম খ্যাত মহা সাধক হাছন রাজা (জন্ম ১৮৫৪-মৃত্য ১৯২২) দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাছন রাজার। হাছন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। তিনি কতো গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। 'হাছন উদাস' গ্রন্থে তার ২০৬ টি গান সংকলিত হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু গান 'হাছন রাজার তিনপুরুষ' এবং 'আল ইসলাহ্' সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শোনা যায়, হাছন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তাঁর গানের পান্ডুলিপি আছে। অনুমান করা চলে, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে বেশ কিছু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাছনের অপর গ্রন্থ 'সৌখিন বাহার'-এর আলোচ্য বিষয়-'স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার(লোকসাহিত্য পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। সৈয়দ মুর্তাজা আলী,'মরমী কবি হাসন রাজা')। 'হাছন বাহার' নামে তাঁর আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাছন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।
মরমী গানের ছক-বাঁধা বিষয় ধারাকে অনুসরণ করেই হাছনের গান রচিত। ঈশ্বরানুরক্তি, জগৎ জীবনের অনিত্যতা ও প্রমোদমত্ত মানুষের সাধন-ভজনে অক্ষমতার খেদোক্তিই তাঁর গানে প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। কোথাও নিজেকে দীনহীন বিবেচনা করেছেন, আবার তিনি যে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে বাঁধা ঘুড়ি সে কথাও ব্যক্ত হয়েছেঃ
গুড্ডি উড়াইল মোরে,মৌলার হাতের ডুরি। হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি। মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা।
জযেমনে ফিরায়, তেমনি ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।
|
এই যে 'মৌলা' তিনিই আবার হাছন রাজার বন্ধু। স্পর্শের অনুভবের যোগ্য কেবল, তাঁর সাক্ষাৎ মেলে শুধুমাত্র তৃতীয় নয়নেঃ
আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে। আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে। |
কিন্তু এই বন্ধুর সনে হাসন রাজার প্রেমের আশা বাঁধা পেত স্বজন ও সংসার। হাছনের খেদঃ
স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল। কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল। |
এদিকে নশ্বর জীবনের সীমাবদ্ব আয়ু শেষ হয়ে আসে- তবু 'মরণ কথা স্মরণ হইল না, হাছন রাজা তোর'। পার্থিব সম্পদ, আকাঙ্ক্ষা আর সম্ভোগের মোহ হাছন রাজাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আবার নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারেনঃ
যমের দূতে আসিয়া তোমার হাতে দিবে দড়ি
টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরিরে
সে সময় কোথায় রইব (তোমার) সুন্দর সুন্দর স্ত্রী
কোথায় রইব রামপাশা কোথায় লক্ষণছিরি রে
করবায় নিরে হাছন রাজা রামপাশায় জমিদারী
করবায় নিরে কাপনা নদীর তীরে ঘুরাঘুরি রে
(আর) যাইবায় নিরে হাছন রাজা রাজাগঞ্জ দিয়া
করবায় নিরে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া রে
ছাড় ছাড় হাছন রাজা এ ভবের আশা
প্রাণ বন্ধের চরণ তলে কর গিয়া বাসা রে।
টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরিরে
সে সময় কোথায় রইব (তোমার) সুন্দর সুন্দর স্ত্রী
কোথায় রইব রামপাশা কোথায় লক্ষণছিরি রে
করবায় নিরে হাছন রাজা রামপাশায় জমিদারী
করবায় নিরে কাপনা নদীর তীরে ঘুরাঘুরি রে
(আর) যাইবায় নিরে হাছন রাজা রাজাগঞ্জ দিয়া
করবায় নিরে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া রে
ছাড় ছাড় হাছন রাজা এ ভবের আশা
প্রাণ বন্ধের চরণ তলে কর গিয়া বাসা রে।
মরমী সঙ্গীতকে ভাবুকদের মনের অনুরাগের ফসল বলা হয়। মরমী কবি তার হৃদয়ের বাসনা আপন সৃষ্টির মাঝে ফুঁটিয়ে তুলেন কিন্তু সেখানে প্রতিবিম্ব হয় দেশ, কাল, প্রাত্রের মনের কথায়। সিলেটের মরমী সাহিত্যের অব্যাহত ধারায় আরেক মহাত্মা কবি 'আরকুম শাহ' (১৮৭৭-১৯৪১) সিলেট গীতি সাহিত্যেঃ আরকুম শাহ'র জনপ্রিয় একটি গানঃ
সোনার পিঞ্জিরা আমার কইরা গেলায় খালিরে
হায়-রে আমার যতনের পাখি
সুয়ারে, একবার পিঞ্জিরায় আও দেখি
আজ্ঞা মতে এই দেহাতে কইলা পরবাস
এখন কেন যাও ছাড়িয়া করিয়া নৈরাশ -রে।
মরমী মতবাদে মূলত প্রেম বা মহব্বতের প্রাধান্যই বেশি। মরমীবাদ সম্পর্কে ইমাম শামি (রহঃ) বলেন; হৃদয়ের অনুভূতির মাধ্যম আধ্যাত্মিক জ্ঞান অজর্ন এর মূল লক্ষ্য। যা হবে সৎ গুন অর্জন এবং অসৎ গুন বর্জনে। ইহাই হচ্ছে পরম সত্তা আল্লাহর পূর্ণ জ্ঞানার্জন ও তার নৈকট্য লাভের রহস্যময় উপলব্ধিক । স্রষ্টা ও সৃষ্টির কিছু কিছু রহস্য বুঝতে হয় প্রেমের মাধ্যম হৃদয় দিয়ে । স্রষ্টার উপস্থিতি শুধু হৃদয়ের অনুভুতিতেই উপলব্ধ । হাছন রাজা এ বিষয়ে লিখেছেন ;
অন্য পন্থে নাহি গিয়া প্রেম পন্থে গেলে
মিলিবে মিলবে খোদা হাছন রাজায় বলে ।
সিলেটে মরমী সঙ্গীতে প্রেম বিরহ ছাড়া সৃষ্টি তত্ব, ভাব তত্ব, ধর্ম দর্শন, মানব কল্যাণ সহ বিভিন্ন ভাব ধারার রচিত বলে গবেষকদের লিখায় পাওয়া যায়। দৃষ্টান্ত স্বরুপ মরমী গবেষক মধ্যযুগের কবি তাজ উদ্দীন মোহাম্মদের একটি কবিতা, যা সৃষ্টি তত্বের উপর কবি লিখেছেন
নিজ নুরে আমার নুর পয়দা কৈলেন ফের
আমার নুরেতে পয়দা তামাম জাহান
আরশ, কুরশী, লওহ কলম ও লা-মাকান
কবি তাজ উদ্দীনের কবিতার সারাংশ পাওয়া যায়, মধ্যযুগের কবি আলাওলের এ কবিতা থেকেঃ
ইচ্ছিলেক নিজ সখা করিতে প্রচার
নিজ সখা মোহাম্মদ প্রথমে সৃজিলা
সেই জ্যোতি নুরে ত্রিভূবন নির্মীলা
আধ্যাত্মিক গান ভাববাদী মানুষকে আধ্যাতিক জগতের সন্ধান দিতে সহায়ক তাই সৈয়দ শাহনুর লিখেন;
অজুদে মজুদ আছে লীলার কারখানা
সৈয়দ শাহনুরে কইন দেখলে তনু ফানা।
ভাঙ্গিয়া সকল রঙ্গ মিশিব ছেহাতে
আদ্যেত আছিল প্রভু শূন্যের শরীর
ছেয়া রঙ্গে নিজ অঙ্গে হইলেন্ত স্থির ।
সৈয়দ শাহনুরে কইন দেখলে তনু ফানা।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সিলেটের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে । উপমহাদেশীয় মানচিত্রে আদিকাল হতেই সিলেটভূমির কায়িক অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট । হযরত শাহজালাল (র.)-এবং তাঁর সঙ্গী ৩৬০ জন সাধকপুরুষের প্রভাবে সিলেট অঞ্চলে এক প্রাণবন্ত তওহীদী ভাবমণ্ডলের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল যা বাংলাদেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে দক্ষিণপূর্ব ও দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল । মধ্যযুগ সিলেটের সূফী সাধকগণের গীতি-কবিতা চর্চার সাফল্যের যুগ । এ যুগই ছিল বাংলা সাহিত্যের সোনালী যুগ । এ সময়ে আরাকানে বাঙালি মুসলিম চিৎপ্রকর্ষের উজ্জ্বল বিকাশ ঘটে। বাংলার রাজধানী গৌড় সহ নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহে নিঃসন্দেহে মুসলিম বাঙালি সভ্যতার সৌধ নির্মিত হতে থাকে এবং মুসলিম দরবারী পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক বিকাশ পর্যায়ের সূচনা হয় । মুসলমান কবিগণ আপন আধ্যাত্মিক অভীপ্সা চরিতার্থের প্রয়াসে আধ্যাত্মিক সঙ্গীত-জগত নির্মাণ করে ইসলামী ইতিহাসের আবহমান সূফী সাধনার ধারাটিকে বাংলা ভাষায় গতিশীল করেন । মধ্যযুগের এই অন্ত্যপর্বে যে কয়েকজন সাধক কবির আবির্ভাবে মরমী কবিতার জগত কথা ও সুরে বাক্সময় হয়ে ওঠেছে । তাদেরই অন্যতম 'শেখ চাঁদ' (জন্ম ১৬৫০- মৃত্যু ১৭২৫) ছিলেন এককালের সিলেটের খন্ড রাজ্য সমূহের মধ্যগণ্য ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যবিদ। তাঁর রসুল বিজয় কাব্যটি হজরত রাসুলে পাক (সা.)-এর বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম জীবনী। শেখ চান্দ ধর্মতত্ত্ব বিষয়ের উপর ‘শাহ্ দৌলা পীরপুস্তক’ বা ‘তালিবনামা’ কাব্যও লিখে গেছেন। ‘তালিবনামা’ গ্রন্থে শেখচান্দ বলেন;
‘এ সব রঙ্গের জন্ম ছেহা জন্ম হোতে ভাঙ্গিয়া সকল রঙ্গ মিশিব ছেহাতে
আদ্যেত আছিল প্রভু শূন্যের শরীর
ছেয়া রঙ্গে নিজ অঙ্গে হইলেন্ত স্থির ।
সিলেটের কালজয়ী ইতিহাসে দেশে বিদেশে সর্বজনীন জনপ্রিয়তার লাভ করেছেন; শেখ ভানু (জন্ম ১৮৪৯ - মৃত্য ১৯১৯) শেখ ভানুর -নিশীতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা , নিশীতে যাইও ফুলবনে' গানটি পৃথিবীর অনেক ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে । এই বিখ্যাত গানটির কথা আরো দুজন কবিকে উৎসাহী করেছে বলে অনেক গবেষকদের ধারনা । তাদের দুজনেরই কিছু কথা রদবদল আছে । এ যেন এক ফুল-তিন মালী । একটি গান, তিনজন গীতিকারঃশেখ ভানু,রাধারমণ দত্ত ও জসীম উদ্দীন । শেখ ভানু মানব দেহের শেষ পরিণতি ভেবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মনের আবেগে বললেন হায়-রে সোনার তনু - - আখের তোর এই হাল। এভাবে শেখ ভানু সংসারের অনিত্যতা প্রত্যক্ষ করে, দুনিয়ার মোহ, মায়া, লোভ প্রভৃতি ত্যাগ করে আল্লাহর পথে ফকির হয়ে পরমাত্মার সন্ধান করতে থাকেন। এ বিষয়টি শেখ ভান তাঁর নিজের ভাষায় বর্নণা দিয়ে লিখেন;
এক রোজ বসে আছি নৌকার উপর পানির মধ্যে দেখিলাম করিয়া নজর হায়-রে; পানির উপর দেখিলাম করিয়া নজর । মুর্দা মানুষ ভাসে এক 'মাঝ দরিয়ায়' উপরে বসিয়া কাক চক্ষু তার খায় দেখিয়া আফসোস হইল দিলের ভিতর কাঁন্দিয়া কইলাম তন-রে কি অইবে তোর। কোথা রইলা মাতা পিতা ভাই বন্ধুগণ কোথায় রইল ঘর বাড়ি অঙ্গের বসন স্ত্রী-পুত্র ছাড়াইয়া কে ভাসাইল তরে মাছ-মাছলী টাইন্যা খায় পানির উপরে। |
হবিগঞ্জ জেলার ভাদিকারা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মনসুর উদ্দীন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার বাউল গান সংগ্রহ করে হারামণি ম্যাগাজিনে ১৯৪২ প্রচার করেন। শেখ ভানুর অনেকটি গান উক্ত ম্যাগাজিনে অন্তর্ভক্ত হয়েছে বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। তার জনপ্রিয় অন্যতম গান হচ্ছে;
(১)
আমি পাড়লাম না-রে -
আমার মনকে বুঝাইতে,
তোমরানি দেইকাছো কেউ -
কদম তলায় ফুল ফুইঠাছে
(২)
নিশিতে যাইও ফুল বনে-রে ভ্রমরা -
নিশিতে যাইয় ফুল বনে
নয় দরজা করি বন্ধ লইয় ফুলের গন্ধ
অন্তরে জপিয় বন্ধের নাম রে ভ্রমরা।
জ্বালাইয় দিলের বাত্তি
ফুল ফুটিবে নানান জাতি-হে ।
গান বা ছন্দের ভাব ও বিষয়গুলো এমন যে; সকল হৃদয় অনুধাবন করতে অক্ষম। সত্য হল বাস্তবিক পক্ষে এগুলো আধ্যাত্মিকতায় সমুজ্জল । কেবল মননশীল ও অনুভূতিশীল পাঠক বা শ্রুতাই হৃদয়াঙ্গম করতে সক্ষম। মরমীবাদের গান আত্মা ও পরম আত্মার মিলন সংক্রান্ত বিষয়ে রচিত। আশিক তার মাশুককে পাওয়ার জন্য সদায় ব্যাগ্র। তবুও তার দর্শন বা মোলাকাত সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রেমিক তার মাসুকের উদ্দেশ্যে আকুতি-মিনতি ভরা কন্ঠে আশা ব্যক্ত করে। যেমন সিলেটের আরেক প্রখ্যাত সাধক দুর্বিন শাহ (জন্ম ১৯২০- মৃত্যু ১৯৭৭) গানে বলেন;
কেমনে রহিব ঘরে বন্ধু বিনে একা
সখি প্রাণের বন্ধু এনে দেখা
ভুবন মোহন রূপের কিরণ নয়ন দুটি বাঁকা
দেখে তার বাঁকা নয়ন যায় না ঘরে থাকা।
বন্ধুয়ার ওই মোহন ছবি আমার মনে আঁকা
কুমলও যুগলও পদে রাধা নাম লিখা
না জানি কোনদেশে রইল আমার প্রাণও সখা
দুর্বিন শাহ কয় উড়ে যাইতে গায়ে নাই পাখা।
সাধক দুর্বিন শাহের লেখা ‘নমাজ আমার হইল না আদায়’ শীর্ষক গানটি কলিকাতার চলচ্চিএকার ঋত্বিক ঘটক তার 'গপ্পো' চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন। দুর্বিন শাহ'র অধিকাংশ গানে সুফি ও মরমিবাদ যথেষ্টভাবে ফুটে উঠলেও এসবের বাইরে ভিন্ন মেজাজের অসংখ্য গান লিখেছেন। শ্রেণী বিভাজন করলে এসব গানগুলোকে বাউল, বিচ্ছেদ, আঞ্চলিক, গণসংগীত, মালজোড়া, জারি, সারি, ভাটিয়ালি গানসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। দুর্বিন শাহ'র জন্ম ছাতকের সুরমা নদীর উত্তর পারে নোয়ারাই গ্রামের তারামনি টিলায়। কালান্তরে এই স্থান দুরবীন টিলা নামে পরিচিত হয়।