বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে জনপ্রিয় একটি নাম ''শাহজালাল (রহ)''। এ নামটি বিশেষ করে
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল সিলেট বিভাগের মানুষের কাছে অতি প্রিয় । দেশ জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। সময়ের শত পরিবর্তনের মাঝেও শাহ জালাল (রহ) যুগযুগান্তর ধরে এতদ্ব অঞ্চলে রাষ্ট্রীয়
ও সামাজিক দিক দিয়ে সর্বপ্রকার মানুষের কাছে হূদয়ের ধন, নয়নের মণি ও শিরের তাজ হিসেবে গণ্য। দেশ কিংবা বিদেশই হোক
সিলেটবাসীরা গীতে-গানে এমনকি বিভিন্ন এবাদতগারসহ নিজ কর্মসংস্থান স্থাপনের মধ্যদিয়েও
শাহজলাল (রহ) স্মরণকে উজ্জিবিত রাখছেন । শাহজালাল (রহ) এর সিলেট
আগমনের আজ সাতশত নয় বৎসর অতিবাহিত হল। এর মধ্যদিয়ে মানব
সমাজের বিরাট একটা ব্যবধান ঘটে যাওয়ার পরেও সিলেটবাসীরা ধারাবাহিক ভাবে প্রজন্মের
পর প্রজন্ম পর্যন্ত শাহজালাল (রহ) নাম হূদয়ে ধারণ করে আসছেন । তার কারণ কি ? এ জানতে সুদুর অতিত থেকে। বর্তমান সিলেট বিভাগ রামায়নযুগে ''শ্রীহট্ট''
হিসেবে পরিচিত হতো। ঐ দুর অতিতে সিলেটের
সর্বমোট লোসংখা অল্প-সল্প থাকলেও তৎকালীন শ্রীহট্টমণ্ডল বর্তমান সিলেট
বিভাগের চেয়ে আয়তনে অনেক বড় ছিল। প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থ কামাখ্যা তন্ত্র অনুযায়ী
প্রাচীন কামরুপ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমাই প্রাচীন শ্রীহট্ট ছিল । যোগিনী তন্ত্রে শ্রীহট্টের সীমার বিবরণ
এরকম:
পূর্ব্বে স্বর্ণ নদীশ্চৈব
দক্ষিণে চন্দ্রশেখর
লোহিত পশ্চিমে ভাগে উত্তরেচ নীলাচল
এতন্মধ্যে মহাদেব শ্রীহট্ট নামো
নামতা
ছিল ঐতিহাসিক তথ্য মতে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা
জেলার কিছু অংশ নিয়ে ভারতের বর্তমান আসাম প্রদেশ পর্যন্ত প্রাচীন শ্রীহট্ট বিস্তৃত
ছিল। মহাভারত সময়কালে কামরুপ অধিপতি রাজা ভগদত্ত বর্তমান সুনামগঞ্জ
জেলাধীন লাউড় পর্বতে এ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্টিত করার জন্য রাজধানী স্থাপন
করে ছিলেন।
যার ভগ্নাবশেষ আজও বিদ্যমান রয়েছে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পরবর্তি সময়ে সিলেট অঞ্চলের ভৌগোলিক রুপরেখার পরিবর্তন
ঘটলে লাউড়, গৌড় ও জৈয়ন্তিয়া এই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন
রাজ্যে বিভক্ত ছিল প্রাচীন শ্রীহট্ট। অনুমান করা হয়,
লাউড় রাজ্যের সীমানা বর্তমান সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা ও ময়মনসিংহ
জেলা এবং হবিগঞ্জ জেলার কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল লাউড়। তদ্রুপ গৌড় রাজের
অবস্থান সিলেট শহর ও শহরের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণে বহু
দুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সিলেট বিভাগে আরো একটি
প্রাচীন রাজ্যের নাম ছিল জয়ন্তীয়া । সিলেট শহর হতে ৪০ কিলোমিটার
দূরে জৈন্তা-খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে জৈন্তাপুর রাজ্যের অবস্থান ছিল। প্রায় ১২শ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক, ভূগৌলিক,
সামাজিক ও সাহিত্যিক ভাবে গৌড় রাজ্য সিলেট বিভাগের ইতিহাসে
সর্বদিগে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি
সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে বলা হয়, ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে
তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের মধ্য দিয়ে
সিলেট অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে । বঙ্গ বিজয়ের প্রায়
একশত বছর পর সিলেটের গৌড় রাজ্য গোবিন্দ নামের রাজার দ্বারা অধিকৃত হয়। রাজা গোবিন্দ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত রয়েছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অচ্যুতচরণ চৌধুরী রাজা গোবিন্দকে সমুদ্রতনয় বলে পরিচয় করেন। উল্লেখ্য যে, গোবিন্দ গৌড় রাজ্যের অধিপতি বলে ‘গৌড় গোবিন্দ’ নামে অভিহিত
হন। গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে, তত্কালে সিলেটের টুলটিকর মহল্লায় ও হবিগঞ্জের তরফে মুসলমান বসতি ছিল। শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যের রাজা গৌড়-গোবিন্দ অত্যাচারি ছিল। গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মোসলমান নিজ ছেলের
জন্ম উত্সব উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধি সাবস্ত
হন। ফলে গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হ্ত্যা করে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তত্কালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর
হত্যা কাণ্ডের অভিযোগ জানান। শামস উদ্দীন ফিরুজ
শাহ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর অধীন সামন্ত রাজা ছিলেন । অভিযোগের পেক্ষিতে গোবিন্দকে শায়েস্তা করার জন্য বঙ্গের রাজা শামসুদ্দীন তাঁর
ভাগিনে সিকান্দর গাজীকে প্রখণ্ড সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ
করেন। সিকান্দর গাজী তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রাজধানী সোনার গাঁ'য়ে সৈন্য সমাবেশ করেন। সোনার গাঁ থেকে শাহী
সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দ ভৌতিক শক্তির সাহায্যে
মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নীবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে ফেলে। গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহত ও বিফল মনোরথের সংবাদ
দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন। পরবর্তিতে সম্রাট তাঁর রাজদরবারী আমেল-উলামা সহ জ্যোতিষদের সাথে আলোচনায় অবহিত
হলেন যে, আধ্যাতিক শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির নেতৃত্বে
অভিযান প্রেরণ করা হলে গৌড়-গোবিন্দের যাদু বিদ্যার মোকাবেলা করে সিলেট বা শ্রীহট্ট
জয় সম্ভব হবে। সম্রাট অনুসন্ধান করে তাঁর সৈন্য বাহিনীর
চাউনিতে সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে যুগ্য হিসেবে বিবেচিত করে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব দেয়ার
অনুরুধ জানান। তিনি 'সৈয়দ নাসির উদ্দীন' সম্রাটের আদেশে সম্মত
হলে সম্রাট তাঁকে সিপাহসালার সনদ প্রদানের মাধ্যমে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণের প্রস্তুতি
নেন। এ দিকে শাহ জালাল তাঁর মামা ও গুরু বিখ্যাত দরবেশ সৈয়দ আহমদ
কবিরের আস্তানায় আধ্যাতিক সাধনায় আরব দেশের মক্কা শহরে অবস্থান করছিলেন। শাহজালাল ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখে মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবিরকে
তা জানান। দরবেশ স্বপ্ন শোনে শাহজালালকে ধর্ম প্রচারে ভারতবর্ষে যাবার
পরামর্শ দেন। যাত্রাকালে দরবেশ কবির শাহ জালাল (রহ) এর
হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বললেনঃ যে স্থানে এই মাটির "স্বাদ" "গন্ধ"
ও "বর্ণের" মিল এক হবে, সেখানেই ধর্ম প্রচারের
জন্য আস্তানা গড়বে। মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (রহ) এর দোয়া লয়ে
শাহ জালাল (রহ) ধর্ম প্রচার অভিযানে আরবের মক্কা শরিফ হতে যাত্রা শুরু করেন। সিলেট আসার পথে ইরাক আফগান সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে শাহ জালাল আউলিয়ার কেরামতি
ও আলৌকিক বিভিন্ন ঘটনা প্রকাশিত হতে থাকে। যার ফলে শাহ জালালের
শিষ্য সংখ্যা বর্ধিত হতে চলে। একসময় শাহ জালাল তাঁর
সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে আসেন । ঐতিহাসিক আজহার উদ্দীনের
মতে দিল্লীতে বুরহান উদ্দীনের সাথে শাহ জালালের সাক্ষাত হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন
নিজের দুঃখময় কাহিনী তাঁর নিকট বর্ণনা করেন । শাহ জালাল দিল্লী হতে বুরহান উদ্দীন সহ ২৪০ জন সঙ্গীসহচর নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্য
রওয়ানা হন । শাহ জালাল সাতগাও এসে ত্রিবেণীর নিকট দিল্লীর
সম্রাট প্রেরিত অগ্রবাহিনী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন শাহ জালাল সম্পর্কে অবগত হয়ে তদ্বীয় শিষ্যত্ব গ্রহনের অভিপ্রা
ব্যক্ত করে শিষ্যত্ব গ্রহনে ধন্য হন। পথে পথে শাহ জালালের
শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল । ত্রিবেনী থেকে বিহার
প্রদেশে আসলে আরো কয়েকজন ধর্ম যুদ্ধা অনুসঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত একহাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার
পদাতিক সৈন্য সহ শাহ জালাল নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনার গাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে
মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
শাহ জালাল সোনার গাঁ আসা মাত্রই শাহ সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাত ঘটল। সিকান্দর গাজী শাহ জালালকে সসম্মানে গ্রহন করলেন। শাহ জালাল তাঁর সঙ্গী অনুচর ও সৈন্য সহ শাহ সিকান্দরের শিবিরে সমাগত হয়ে সিকান্দর
হতে যুদ্ধ বিষয়ে সব বিষয় অবগত হন। সিকান্দর শাহ জালালের
আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহন পুর্বক সিলেট অভিমুখে যাত্রা করলেন । এভাবে শাহ জালালের শিষ্য সংখ্যা ৩৬০ জনে পৌছে। এ দিকে গৌড় গৌবিন্দ নিজেস্ব চরদ্বারা শাহ জালালের সমাগম সংবাদ পেয়ে নতুন এ দল
যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারে, সে ব্যবস্থা
অনুসারে নদীর সমস্ত নৌ চলা-চল বন্ধ করে দেয় । শাহজালালের ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি তাঁর শিষ্যদের
নিয়ে বিনা বাধায় জায়নামাজের সাহয্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন। এখানে গৌড়ের সীমান্ত রক্ষীরা অগ্নীবাণ প্রয়োগ করে তাদেরকে প্রতিহত করতে চায়। কিন্তু আর্চায্য ভাবে নিজেদের অস্ত্র-সস্ত্র নিজ সৈন্যের উপর পতিত হয়ে নিহত হতে
লাগল । মুসলমান সৈন্যের কোন ক্ষতি করতে পারে নাই । গোবিন্দ সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে বরাক নদীতেও নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ
করে। শাহ জালাল পুর্বের মত জায়নামাজের সাহায্যে বরাক নদী পার হন। বরাক নদী পারা-পারে বাহাদুরপুর হয়ে বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহ
পুর নামক স্থানে রাত্রি যাপন করেন। উল্লেখিত তথ্য সম্মেলিত
প্রাচীন গ্রন্থ ''তোয়ারিখে জালালী'' উদ্ধৃতিতে ঐতিহাসিকগণ লিখেনঃ
চৌকি নামে ছিল যেই পরগণা দিনারপুর
ছিলটের হর্দ্দ ছিল সাবেক মসুর
সেখানে আসিয়া তিনি পৌছিলা যখন
খবর পাইলা রাজা গৌবিন্দ তখন ।
এপারে হজরত তার লস্কর সহিতে
আসিয়া পৌছিলা এক নদীর পারেতে
বরাক নামে নদী ছিল যে মসুর
যাহার নিকট গ্রাম নাম বাহাদুরপুর।
যখন পৌছিলা তিনি নদীর কেনার
নৌকা বিনা সে নদীও হইলেন পার।
সর্ব প্রকার কল-কৌশল অবলম্বন করে রাজা গৌড়-গোবিন্দ যখন
দেখলেন মোসলমান সৈন্যদের বাঁধা দেয়ার সকল প্রয়াসই বিফল হচ্ছে, তখন শেষ চেষ্টা করার লক্ষে যাদু মন্ত্র সহ এক
প্রকাণ্ড লৌহ ধুনুক শাহ জালালের কাছে প্রেরণ করে। যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা উক্ত ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে
পারে তখন গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। শাহ জালাল তাঁর দলের লোকদের ডেকে বললেন; যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ খাজা হয় নাই
বা বাদ পরে নাই একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুক "জ্যা" করতে। অতপর মুসলিম সৈন্যদলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার
সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে উপযুক্ত পাওয়া গেল এবং তিনিই ধনুক জ্যা করলেন। গোবিন্দের যাদুর ধনুক ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে শোনে ভগ্ন
মনোরথ হয়ে রাজা গড়দোয়ারস্ত (বর্তমান মজুমদারী) দুর্গে প্রবেশ করে আত্মগোপন করে। এদিকে শাহ জালাল ফতেপুর হতে যাত্রা করে সুরমা তীরে অবস্থান
নিলেন । এ নদী পার হয়েই গৌড়ের রাজধানী । উল্লেখ্য যে, উত্তর পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময়
সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়ে যায়। সিলেট বিভাগের বেষ্টনী হিসেবে দর্তব্য এ নদী গুলো প্রাচীন কালে প্রবল স্রোতে প্রবাহিত
হত। বর্ষা কালের দৃশ্য প্রায় সাগরের মত দেখাত। ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সুরমা নদীকে নহরি আজরফ বলে
আখ্যায়িত করেছেন । শাহ জালাল আউলিয়ার কেরামতি
ও আলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায় রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। যার ফলে গোবিন্দ শক্রবাহিনীকে কিছু সময় ঠেকিয়ে রাখার
জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলা-চল নিষিদ্ধ করেন। তা সত্ত্বেও শাহ জালাল (রহ) পূর্বের মতো এবারও জায়নামাজ বিছিয়ে সুরমা নদী পার
করেন। গোবিন্দ গড়দুয়ারস্থিত রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে
শহরের ছয়/সাত মাইল পূর্বদিকে পেচাগড়ের গুপ্ত গিরি দুর্গে আশ্রয় নিলেন । এরপর থেকে তার আর কোন হদিস বা খবর মেলেনি। শাহ জালাল তিন দিন সিলেটে অবস্থান করার পর, গড়দোয়ারে অবস্থিত রাজ বাড়ি প্রথমে দখল নিলেন। কথিত আছে যে, উক্ত গড়দোযয়ারের পাশেই সাত স্তরে উন্নীত মিনারের বা
মনার টিলা নামে একটি ছোট সুউচ্চ টিলার উপর রাজার অভিষ্টদেবের নামে উৎসর্গীকৃত
মন্দির ছিল। শাহজালাল (রহ) আদেশে আজান
ধ্বনী উচ্চারিত হলে তাহা ধ্বসিয়া যায়। শাহ জালাল (রহ) আধ্যাতিক সাধনায় বিনা সমরে গৌড়ে প্রবেশ করেন এবং গৌড় রাজ্য মুসলমানদের
দ্বারা অধিকৃত হয়। কিংবদন্তী মতানুসারে খ্রিস্টীয়
১৩০৩ সালে শাহজালাল (রহ) ৩৬০ জন সঙ্গী সহ দিল্লির সুলতান্দের প্রেরিত সিকান্দর গাজীর
সাথে গৌড় রাজ্যে উপনীত হয়ে সিলেট বিজয় লাভ করেন।
সিলেট বিজয়ের পর দিল্লীর সুলতান সনদের মাধ্যমে শাহজালাল (রহ) কে সিলেটের শাসন
ভার অর্পিত করেন। শাহজালাল সম্রাটের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে
জানিয়ে দেন যে, দুনিয়ার ধন-দৌলত, বিত্ত বেশাতের প্রতি আমার কোন লোভ নেই। শাহজালালে দুনিয়া
বিরাগী এ মনোভাব সম্রাট্টকে ভাবাম্ভিত করে তুলে। পরে সম্রাট দরবেশ শাহজালাল (রহ) এর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখিয়ে সিলেটকে খাজানা
মুক্ত অঞ্চল বলে ঘোষনা দেন। শাহজালাল মক্কা হতে আসার কালে তদীয় মুরশীদ কর্তৃক দেয়া মাটি
সঙ্গে সিলেটের মাটি পরিক্ষায় দেখেন এ মাটির সাথে আরবের মাটির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ মিশে গেছে। তাই স্বীয় মুরশীদের আদেশ অনুযায়ী সিলেট শহরের দরগা মহল্লায় একটি ছোট্ট টিলায়
তাঁর আস্তানা গড়ে এখানে এবাদত বন্দেগি করতে থাকেন এবং ইসলাম ধর্মের শ্বাশত বাণী প্রেম
ও ভক্তি ভাবে মানুষের কাছে পৌছাতে তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে শ্রীহট্ট তথা সিলেটের বিভিন্ন
স্থানে, পরগণায় ও গ্রামে পাঠিয়ে দেন। শুধু ইয়ামনের রাজপুত্র, হাজি ইউসুফ ও হাজী
খলিলসহ আরো কয়েকজন খাদেমকে তার কাছাকাছি রাখলেন। এখান থেকে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন এবং নিজের আস্তানাকে ধ্যান ও সাধনার
এক অনুপম লীলাক্ষেত্রে পরিণত করলেন। হযরত শাহজালাল ছিলেন
কিংবদন্তি তুল্য। প্রেম-ভক্তি, ভাব-বিশ্বাষের পথে মানুষকে পরিচালিত করে সিলেটের মানুষের কাছে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র
হয়ে উঠেন।
যার ফলে তাঁর পূণ্যময় প্রত্যেক স্মৃতি গুলো আজও অত্র অঞ্চলের
মানুষ ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে মান্য করে। লোক বিশ্বাস আছে;
শাহ জালালের কবর জিয়ারতের উছিলায় মনের বাসনা পূর্ণ হয়। তাই প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষ তাঁর দরগাহ'তে আসা যাওয়া করে এবং তাঁকে অসিলা বা উপলক্ষ করে বিভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা নিবেদন করে এবং তাঁকে খোদার করুনা হিসেবে মান্য করে। এভাবেই তাঁর ভক্তরা ভক্তি ও শ্রদ্ধা ভরে শাহ জালালের সিলেট আগমনকে উপলক্ষ করে তাঁর
স্মৃতিকে যুগের পর যুগ স্মরণে ধারণ করে আসছেন। তাঁর স্মরণে লিখা হয়েছে অগণিত পুথিপুস্তক, গজল, কবিতা ও গান। আর এগুলোকে অবলম্বন করে সিলেটবাসী প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে শাহজালাল (রহ) এর
আগমনকে ধরে তুলতে সক্ষম ।
তথ্যসুত্র- (1) শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ , অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪। (2)সিলেট বিভাগের ভৌগোলিক ঐতিহাসিক রুপরেখা সৈয়দ
মোস্তফা কামাল; প্রকাশক: শেখ
ফারুক আহমদ, পলাশ সেবা
ট্রাস্ট, সিলেট। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি
২০১১. (3)সিলেট গীতিকাঃ সমাজ ও সংস্কৃতি, ডঃ আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫। (4) Ancient India"
Ramesh Chandra Majumdar, Motilal Banarsidass Publishers, Eighth Edition: Delhi, 1977. (5) Journal of The Royal Asiatic Society, part 1, 1st
January 1920. (6) Rivers and riverine landscape in North East India, By Sutapa
Sengupta Col Ved Prakash, Encyclopedia of North-East India. (7) Indian
Civilization and Culture by Suhas Chatterjee, Culture of north-east India,
(kamarupa) M D Publications, new dheli, 1998. (8) Historical Research Into Some
Aspects Of The Culture And Civilization Of North-East India, By G.P. Singh,
Published by - Gyan Publishing house।
|